মাটি
হালকা বেলে থেকে ভারী এটেল মাটি অর্থাৎ প্রায় সব ধরনের মাটিতেই বেগুনের চাষ করা হয়। হালকা বেলে মাটি আগাম জাতের বেগুন চাষের জন্য উপযোগী। এই ধরণের মাটিতে বেগুন চাষ করতে হলে প্রচুর পরিমাণ জৈবসারসহ অন্যান্য সার ঘন ঘন প্রয়োগ করতে হবে। এটেঁল দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটি বেগুন চাষের জন্য উপযোগী এবং এই মাটিতে বেগুনের ফলন বেশী হয়। বেগুন চাষের জন্য নির্বাচিত মাটি গভীর, উর্বর ও সুনিষ্কাশিত হওয়া প্রয়োজন।
চাষের মৌসুম: তবে রবি মৌসুমে বেগুন চাষ করলে ফলন খরিপ মৌসুমের চেয়ে পাওয়া যায়। রবি মৌসুম অর্থাৎ শীতকালের জন্য সাধারণতঃ আগষ্ট থেকে অক্টোবর পর্যন- বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। খরিপ মৌসুম অর্থাৎ বর্ষাকালীন বেগুনের জন্য জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন- বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। রবি মৌসুমে চাষের জন্য যে কোন জাতের বেগুন লাগানো যেতে পারে, কিন’ খরিপ মৌসুমে চাষের জন্য বারমাসী জাতসমূহ লাগাতে হবে।
বেগুনের জাত
ভাল ফলন পেতে হলে উপযুক্ত জাত নির্বাচন করা একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশে বেগুনের বহু জাত রয়েছে। এক জাত থেকে অন্যজাতে গাছের প্রকৃতি, ফলের রং, আকার, আকৃতি প্রভৃতি বিষয়ে বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশে প্রধানতঃ লম্বা ফল, গোলাকর ফল ও গোলাকার এই তিন ধরণের বেগুনের চাষ বেশী হয়ে থাকে। সব জাতকে মৌসুম ভিত্তিক দুই ভাবে ভাগ করা যেতে পারে, যেমন–শীতকালীন বেগুন ও বারমাসী বেগুন। শীতকালীন জাতের বেগুন রবি মৌসুমে চাষ করা হয় কারণ, এই জাতের বেগুন কেবলমাত্র রবি মৌসুমেই ফল দিতে পারে। আর বারমাসী বেগুন বছরের যে কোন সময় চাষ করা যেতে পারে। নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জাতের পরিচিতি দেয়া হল-
আমাদের দেশের স্থানীয় জাতগুলো হলো : আমাদের দেশের স্থানীয় জাতসমুহ হল- ইসলামপুরী (ময়মানসিংহ), নয়নকাজল(যশোর), সাহেব বেগুন(পটুয়াখালী), খটখটিয়া(ময়মানসিংহ), উত্তরা(রংপুর), রাখাইন বেগুন (পটুয়াখালী ও বরগুনা), প্লাস্টিক বেগুন, মাকড়া(যশোর), উত্তরা(সারাদেশ) ইত্যাদি।
এছাড়াও আমাদের দেশে আরও কিছু উন্নত জাতের বেগুন আছে তাঁর মধ্যে কেজি বেগুন, তাল বেগুন, নয়নতারা, ঝুমকা, কুলি বেগুন, ভোলানাথ ইত্যাদি।
হাইব্রিড জাতগুলো হলোঃ চমক এফ১, বিটি বেগুন,বিজয়, পার্পল কিং, কাজলা (বারি বেগুন ৪), নয়নতারা (বারি বেগুন ৫), তারাপুরী (বারি বেগুন ২), শুকতারা, ডিম বেগুন, মুক্তকেশী,গালিভার, গ্রীনবল-১, শুকতারা, কাজলা এক্সট্রা লং, হীরা ইত্যাদি জাত সমুহ।
ইসলামপুরী– এটি শীতকালীন জাত। এ জাতের গাছে ও ফলে কাঁটা নেই। গাছের উচ্চতা মাঝারি ধরনের ও শাখা প্রশাখাযুক্ত। পাতার রং বেগুনী সবুজ। ফল গোলাকার, কচি অবস্থায় গাঢ় বেগুনী, পরিপক্ক অবস্থায় সবুজাভ বেগুনী। তবে কোন কোন সময় ত্বকে সবুজ বর্ণের ছোপ থাকতে পারে। ফলের শাঁস মোলায়েম ও সুস্বাদু, বীজের সংখ্যা কম। প্রতিটি ফলের ওজন ২০০-৪০০ গ্রাম। গড়ন ফলন ৩৬ টন/হেক্টর। গাছ প্রতি গড় ফল ধরার সংখ্যা ১৩টি।
খটখটিয়া– শীতকালে চাষ উপযোগী জাত। গাছ উচ্চতায় ও বিস্তৃতিতে মাঝারি, পাতা মাঝারী চওড়া। ফল দন্ডাকার ও কালচে বেগুনী। ফল লম্বায় ১৬-২০ সেমি. ও বেড়ে ৩.৫০-৫.৫০ সেমি.। প্রতিটি ফলের ওজন ১০০-১২৫ গ্রাম। গড় ফলন ২৯ টন/হেক্টর।
লাফফা– শীতকালীন জাত ফলের রং বেগুনী এবং গোলাকার। ফলের উপরিভাগ সামান্য খাদালো। ময়মনসিংহের গফরগাঁও এলাকার একটি জনপ্রিয় জাত।
ঈশ্বরদি ১– প্রধানতঃ শীতকালীন জাত। তবে অন্যান্য সময়ও চাষ করলে কিছু ফলন পাওয়া যায়। গাছ কাটাময়, পাতা খাটো ও চওড়া ধরনের। ফল বড়, গোলাকার এবং রং সবুজ ও তার উপর হালকা ডোরা। ফলে বীজ খুব ও খুব সুস্বাদু নয়। এ জাতে পোকা মাকড়ের উপদ্রব খুব কম। প্রতিটি ফলের ওজন ১৫০-২৫০ গ্রাম।
তাল বেগুন বা তল্লা বেগুন– গাছ উচ্চ, বিস্তৃতিতে কম, শাখা ও পাতার সংখ্যা কম। পাতা বড় ও চওড়া। ফল গোলাকার ও চ্যাপ্টাকৃতি। ফলের বেড় দৈর্ঘ্য অপেক্ষা বেশী। ফলের শাঁস মোলায়েম ও সুস্বাদু, বীজের সংখ্যা মধ্যম। প্রতিটি ফলের ওজন ২০০-৪০০ গ্রাম।
নয়ন কাজল: প্রধানত শীতকালীন জাত। গাছের উচ্চতা মাঝারী ধরনের ও শাখা প্রশাখা যুক্ত। ফল বেলুনাকৃতি, লম্বা ২০ সেমি. পর্যন্ত হতে পারে, ফলের রং হালকা সবুজ, বোঁটার কাছে হালকা বেগুনী। চোখের কাজলের মত আচড় আছে। সম্ভবতঃ এ কারণে জাতটির নাম নয়ন কাজল। একটি অধিক ফলনশীল জাত, ফলে বীজের পরিমাণ কম, শাঁস মোলায়েম এবং খেতে সুস্বাদু। প্রতি ফলের ওজন ৩০০-৬০০ গ্রাম।
কেজি বেগুন– শীতকালীন জাত। গাছের উচ্চতা মাঝারি, পাতা চওড়া, ঢেউ খেলানো ফল বোঁটার দিক থেকে ক্রমান্বয়ে মোটা, অনেকটা লাউয়ের মত দেখতে হয়। ফলের রং হালকা সবুজ এবং গায়ে লম্বালম্বি হালকা আচড় আছে। বীজ অত্যন্ত কম, শাঁসালো, নরম এবং অত্যন্ত সুস্বাদু। বেগুন ভাজা, বেগুনী, চপ ইত্যাদি তৈরিতে এর জুড়ি নেই। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে প্রতিটি ফলের ওজন গড়ে ১ কেজি পর্যন্ত পাওয়া যায়। এ কারণে এ জাতটি এখন খুব জনপ্রিয় নয়।
শিংনাথ– একটি বারমাসী জাত। গাছ বেশ উঁচু, পাশেও অধিক, শাখা প্রশাখার সংখ্যা প্রচুর। পাতা সরু ধরনের। এর ফল সরু, লম্বায় প্রায় ৩০ সেমি. ও বেগুনী রংয়ের। বেগুনের মধ্যে বীজ মাঝারি সংখ্যক, খেতে সুস্বাদু। এই জাতের বেগুনের মধ্যে কতকগুলি উপজাত আছে, যেগুলি ফলের আকার, আকৃতি, বর্ণের দিক থেকে পরষ্পর থেকে ভিন্ন। প্রতিটি ফলের ওজন ৭৫-১৫০ গ্রাম। প্রতিটি গাছে গড়ে ৩৯ টি বেগুন ধরে এবং গড় ফলন ৩০ টন/হেক্টর।
ঝুমকো– গাছ খাটো, খুবই ফলনশীল জাত। ফল খাটো, সরু ও ৮-১০ সেমি. লম্বা। বেগুন গাছের গুচ্ছভাবে উৎপন্ন হয়। ফলের ত্বক খুব পাতলা ও শাঁস মোলায়েম। ডগা ও ফলের মাজরা পোকার আক্রমণ কম হয়।
ডিম বেগুন– একটি উচ্চ ফলনশীল বারমাসী জাত। এ জাতে পোকার উপদ্রব খুব কম হয়। ফল ধবধবে সাদা, আকৃতিতে প্রায় ডিমের মত। প্রতিটি ফলের ওজন ৪০-৬০ গ্রাম।
মুক্তকেশী– এটি বারমাসী জাত, আগষ্ট (মধ্য শ্রাবণ-মধ্য ভাদ্র) মাস থেকে বেগুন বাজারে বিক্রয়ের জন্য উঠানো যায়। গাছ মাঝারী আকৃতির, ফল উপবৃত্তাকার ও চকচকে বেগুনী। প্রতিটি বেগুনের ওজন ১৫০-২৫০ গ্রাম।
শুকতারা– বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি হাইব্রিড জাত। সুফলা ও উত্তরা জাতের মধ্যে সংকরায়নের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ফল বেগুনী, গড়ে ১৯ সেমি. লম্বা ও বেড় ৪ সেমি.। উচ্চফলনশীল, প্রতিটি ফলের ওজন গড়ে ৬০ গ্রাম। প্রতি হেক্টরে গড়ে ৮০ টন ফলন পাওয়া যায়। সংকর জাতের কারণে এ জাতটি ঢলেপড়া নামক রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। কৃষকদের জমিতে উৎপন্ন বীজ থেকে বীজ সংগ্রহ করে পরবর্তী বছর বেগুন চাষ করা যাবে না। প্রতি বছরই বীজ নতুন করে সংগ্রহ করতে হবে।
উত্তরা (বারি বেগুন ১)– বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি উন্নত জাত। শীতকাল এ বেগুন চাষের উপযুক্ত সময়। গাছের পাতা ও কাণ্ড হালকা বেগুনী এবং পাতার শিরাগুলো গাঢ় বেগুনী হয়। পাতার নীচের দিকে সামান্য নরম কাটা দেখা যায়। গাছ খাটো আকৃতির ও ছড়ানো হয়ে থাকে। প্রতি গুচেছ ৫-৬টি ফল ধরে। ফলের রং বেগুনী এবং ১৮-২০ সেমি. লম্বা। ফলের ত্বক খুব পাতলা, শাঁস মোলায়েম এবং খেতে সুস্বাদু। হেক্টর প্রতি গড়ে ৬৪ টন ফলন পাওয়া যায়। এ জাতটি ‘ঢলে পড়া’ নামক রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। গাছ প্রতি গড়ে ১৯৫টি ফল ধরে।
তারাপুরী (বারি বেগুন ২)– বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাত। ইসলামপুরী ও উত্তরা জাতের মধ্যে সংকরায়নের মাধ্যমে উদ্ভাবিত, শ্রাবণ-ভাদ্র মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ফল গাঢ় বেগুনী, প্রায় ১৬ সেমি. লম্বা ও বেড় ৬ সেমি.। উচ্চফলনশীল, প্রতিটি ফলের ওজন গড়ে ৯০ গ্রাম, হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৮০ টন। এ জাতটি ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। উৎপাদনের জন্য প্রতি বছর নতুন করে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
কাজলা (বারি বেগুন ৪)– এটি একটি হাইব্রিড জাত। এ জাতের ফলের আকার লম্বা, রং কালচে বেগুনি, চকচকে। গাছ মাঝারি আকৃতির ছড়ানো। গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ৭০-৮০টি, প্রতিটি ফলের ওজন ৫৫-৬০ গ্রাম। জাতটি ঢলে পড়া রোগ সহনশীল। বীজ লাগানোর ৯০-৯৫ দিন পর ফল ধরে এবং ১৯০ দিন পর্যন্ত ফল ধরে। হেক্টর প্রতি ফলন ৫৫-৬০ টন।
নয়নতারা (বারি বেগুন ৫)– এ জাতের ফলের আকার গোল, রং লালচে বেগুনি। গাছ খাড়া আকৃতির। গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ২৫-৩০টি, প্রতিটি ফলের ওজন ১২০-১৩০ গ্রাম। আগাম ফলন দেয়। জাতটি ঢলে পড়া রোগ ও বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ কিছুটা প্রতিরোধ করতে পারে। বীজ লাগানোর ৮০-৮৫ দিন পর ফল ধরে। হেক্টর প্রতি ফলন ৪৫-৫০ টন।
বিজয়– একটি হাইব্রিড জাত, সারা বৎসর চাষ করা যায়। গাছ ডালপালা বিশিষ্ট, সব শাখা প্রশাখায় বেগুন ধরে। ফল উপ গোলাকার, বেলুন আকৃতি, আকর্ষণীয় কালচে বেগুনী রং, বোঁটা সবুজ। ফলের ছাল পাতলা, খেতে সুস্বাদু। প্রচুর ফলন পাওয়া যায়। প্রতিটি বেগুনের গড় ওজন ১৭০ গ্রাম। চারা রোপণের ৪৫-৫০ দিন পর থেকে বেগুন সংগ্রহ করা যায়। অনেক দিন যাবত ফলতে থাকে। চাষের জন্য প্রতি বছর নতুন বীজ সংগ্রহ করতে হয়।
চমক এফ১– এটি একটি হাইব্রিড জাত। আষাঢ় থেকে পৌষ মাসের মধ্যে চারা রোপণ করতে হয়। চারা রোপণের ৫৫-৬০ দিন পর ফল ধরে। গাছ ও পাতা বড়, অনেক ডালপালা, বেগুন লম্বায় প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার। পুতি গাছে ১৫-২০ কেজি ফল ধরে।
কাজল এফ১- বেগুন গোল, রং কালো, প্রতিটি বেগুনের ওজন ৩০০-৪০০ গ্রাম, গাছ বড় ও ঝোপালো।
হাইব্রিড বেগুন- গ্রীন বল (Green Ball)
- বপন সময়কালঃ সারা বছর
- উজ্জ্বল সবুজ রঙের গ্রীন বল জাতটি ঝিমিয়ে পড়া রোগ (ব্যাক্টেরিয়াল উইল্ট) সহনশীল
- ৬০ থেকে ৭০ দিনে ফসল সংগ্রহ করা যায় এবং প্রতিটি গিঁটে থোকায় থোকায় ফল ধরে
- ডিম্বাকৃতির প্রতিটি ফলের ওজন ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম এবং গাছপ্রতি ফলন প্রায় ৮ থেকে ১০ কেজি
- গ্রীন বল জাতের বেগুনের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারি এবং চারা থেকে চারা ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে রোপন করলে উপরে উল্লেখিত ফলনের চেয়েও বেশি ফলন পাওয়া যায়
হাইব্রিড বেগুন- ললিতা (Lalita)
- বপন সময়কালঃ সারা বছর
- ললিতা জাতটি উচ্চমাত্রায় তুলসি বা ঝিমিয়ে পড়া রোগ (ব্যাক্টেরিয়াল উইল্ট) সহনশীল
- প্রতিটি গিঁটে থোকায় থোকায় ফল ধরে
- ৬৫ থেকে ৭৫ দিনে ফসল সংগ্রহ করা যায়
- গাঢ় বেগুনি রঙের প্রতিটি ফলের ওজন ১২০ থেকে ১৫০ গ্রাম এবং গাছপ্রতি ফলন প্রায় ১০ কেজি
- ললিতা জাতের বেগুনের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারি এবং চারা থেকে চারা ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে রোপন করলে উপরে উল্লেখিত ফলনের চেয়েও বেশি ফলন পাওয়া যায়
বীজের পরিমানঃ প্রতি শতকে ০.৫ গ্রাম এর মত বীজ প্রয়োজন হয়।