নিজেকে প্রশ্ন করুন-
★ যে কোন সবজি চাষের ক্ষেত্রে জমি প্রস্তুতের পূর্বেই নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে হবে।
√যে ফসলটা চাষ করতে চান, সে ফসলটাকে কি আপনি পছন্দ করেন?
√সে ফসল চাষের বিষয়ে আপনার কতটুকু জ্ঞান আছে?
√আপনাকে সহায়তা করবে এমন অভিজ্ঞ কেও কি আপনার আশেপাশে আছে?
√আপনার এলাকায় সবজিটার চাহিদা কেমন?
√এই সবজিটার পেছনে খাটা-খাটুনিতে আপনি কি আনন্দবোধ করবেন?
√সবজিটা চাষাবাদে লাভ হওয়ার সম্ভাবনা বা ঝুকি কেমন?
উত্তর পজিটিভ হলে এগিয়ে যান।
★ আপনি কারো মুখে স্ট্রবেরী বা বাগুন চাষ করে রাতারাতি বড় লোক হওয়ার গল্প শুনেছেন। কিন্তু আপনার এসব চাষ সম্পর্কে আগে-পিছে কিছুই জানা নাই। তাহলে আপনার কৃষির শুরুটাই শেষ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।যারা সবজি চাষাবাদ করেন, তাদের কিছু কিছু বিষয় মাথায় রাখা অত্যান্ত জরূরী। নতুবা এই হুজুগে দেশের মাটিতে কৃষক হয়ে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়বে।
১. প্রতিটা সবজির মৌসুম সময়।
২. প্রতিটা সবজির আগাম সময়।
৩. সারা বছরের আবহাওয়ার স্বভাব।
৪. সবজি গাছের সহনশীলতা ও সহ্য ক্ষমতা।
৫. সারা বছরের বাজার ব্যবস্থা, মূল্যের উত্থান-পতন।
৬. সবজি চাষের একটি Target বা লক্ষ্য।
কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে তা আলোচনা করার চেষ্টা করলামঃ-
আসলে আমাদের দেশে বা এলাকায় সবজির মূল্য সারা বছর এক থাকে না। কোন কোন সময় সবজির মূল্য হুঁ হুঁ করে বেড়ে যায় আবার কোন কোন সময় নাটকিয়ভাবে নিচে পড়ে যায়।
যেমন এই শীতে সবজির মূল্য এতো কমে গেছে তা বলার মতো নয়।
শিম-২০০৳ মন যা ৪ হাজার টাকা থেকে নেমেছে। লাউ ৫-১০ টাকা পিস যা মাস দু-১ আগেই ৫০-৭০ টাকা ছিলো৷ ধনিয়া পাতা ১৫-২০ টাকা কেজী, পালং ৪-৫ টাকা কেজী। ফুলকপি, বাধাকপি, মুলা সহ সকল প্রকার সবজির মূল্য এতো কম যে মাঝে মাঝে গাড়ি ভাড়াটাও হতভাগা কৃষকের পকেট থেকে দিতে হচ্ছে। পরিস্থিতি খুব করুণ।
কৃষকের অবস্থা বড়ই নাজেহাল। এমন একটি দেশ যেখানে কৃষিই প্রধান পেশা, এই পেশার পরিশ্রমী মানুষগুলোর হৃদয় বিদাড়ক অবস্থা আর কষ্ট দেখার মতো নয়। আমরা চাইলেই এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন করতে পারি, সুধু আমাদের চিন্তা-ভাবনার একটু পরিবর্তন করতে হবে।
আমাদের সমস্যা হচ্ছে… মৌসুমের সময় সকলে লেংটি মেরে সবজি চাষের জন্য খেতে নেমে পড়ি যে ব্যপক সবজি চাষ করবো আর ব্যপক লাভবান হবো। অনেকে লক্ষপতি হওয়ার স্বপ্নও দেখেছেন। কিন্তু হলোটা কী? ★সবজির মূল্য সারা বছরের কখন কেমন থাকবে তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব না, তবুও অনেকটা ধারনা করা যায়।
★★★ আমরা যদি সারা বছরের সবজির দিকে লক্ষ করি, তাহলে দেখবো এই শীতকালেই সবচেয়ে ব্যপক হারে সবজি চাষ হয়ে থাকে। ফুলকপি, বাধাকপি, মূলা, শিম, বেগুন, পালং, গাজর সহ হরেক রকমের নিত্য-নতুন সবজি বাজারে দেখা যায় যা অন্য সময় দেখা যায় না। মূলত শীতকালটাই সবজি চাষের এক ভালো সময় এবং এ সময়েই সবজি ভালো হয়। অনেকে ধান কেটে সে জমিতে শীতকালীন সবজি চাষাবাদ করার সুযোগ পায়। এই শীতকালীন সবজি পৌষ এবং মাঘ (December-February) মাসে বাজারে থাকে তাই এ সময় বাজার মূল্য কম হয়।
★ ফাল্গুনমাসে (15 February…) বাসন্তি ককিলের ডাক শুনলেই বুঝবেন… বাজারমূল্য বৃদ্ধির সময় হয়েছে। আসলে এসময়বাজারমূল্যবৃদ্ধিরকিছুকারণআছে, তাওজানাদরকার-
ক. শীতকালীন সবজির শেষ হওয়া।
খ. গরমে নতুন পোকামাকড়ের আগমন।
গ. খরা।
আসলে হুট করে একসাথে শীতকালীন সবজি শেষ হওয়াতে বাজারে একটু টান পড়ে যায়।
এছাড়াও কারো খেতে যদি শীতকালীন সবজি থেকেও থাকে, পোকামাকড়ের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার, শিলাবৃষ্টি, খরা ইত্যাদির কারনে সবজি নষ্ট হয়ে যায়। এ কারনে এ সময় সবজির মূল্য বৃদ্ধি হতে বাধ্য।
লাউ এর মূল্য আবারও ৪০-৫০ হয়ে যায়, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, করলাও হাফ সেঞ্চুরী করে। শসা ও ঢেড়স সেঞ্চুরী করার চেষ্টা করে আর উচ্ছেতো ডাবল সেঞ্চুরী করে বসে। লাল শাক, পুই শাক এবং ডাটা জাতীয় শাক গুলোও কেজীতে ২০ টাকা পাওয়া যায়।
সাধারণ কৃষক যখন শীতকালীন সবজি নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখনই চতুর ও বুদ্ধিমান কৃষক মাঘ মাসের শুরুতে শাকের বীজ বপন করে ১ মাসেই তা তৈরী করে নেয়। মাঘ মাসের শেষ দিকে ডাটা শাকও বাজারে উচ্চ মূল্যে বিক্রি হতে দেখা যায়।
লাউ, চাল কুমড়া, করলা, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, পুই শাক, ঢেড়স ইত্যাদির জন্য শীতের আগেই বীজ বপন করে নিতে হয়।
শসার জন্য মাঘের শুরুতে বীজ বপন করলেই হয়। শসা ও লাউ ঠান্ডা হওয়ায় গরমের শুরুতে এদের একটি স্পেশাল চাহিদা লক্ষ করা যায়।
আগাম ঝিঙ্গা চাষের জন্য পৌষ মাসের শেষ দিকে বীজ ফাটিয়ে পলিব্যগে অথবা বিশেষ পরিচর্যার মাধ্যমে চারা তৈরী করে নিয়ে রোপন করে আগাম তুলতে পারলে ভালো মূল্য পাওয়া যায়।
তবে এই মৌসুমে সবজি চাষের জন্য নিয়মিত সেচ, স্প্রে সহ অন্যান্য পরিচর্যার প্রয়োজন একটু বেশি হয়।
★★★ রমজানটার্গেট-
• আপাতত বৈশাখ (15 April…) মাসে রমজান হচ্ছে। সারা দিন রোজা রাখার পর সন্ধায় বিশেষ ইফতারী, তার পর রাতে আর শেহরীতে আর বেশি কিছু খাওয়া হয়ে ওঠে না। তাছাড়া বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে ফলনও একটু বৃদ্ধি পায়। তাই অনেক এলাকায় এ সময় সবজির মূল্য পড়ে যায়।
তবে এ মাসে শসা, বেগুন, মরিচ, কলা, তরমুজ সহ আরো বেশ কিছু সবজি আর ফলের বিশেষ চাহিদা হয়। তাই এ সকল ফসলকে রমজানের জন্য নির্ধারণ করতে পারেন।
হাইব্রিড শসা হলে রমজানের ২ মাস আগে বীজ বপন করতে হবে৷ বেগুনের ক্ষেত্রে ৩ মাস আগে চারা রোপন করলেই হবে। তরমুজও খুব লাভজনক একটি ফল, সঠিক সময় বুঝে করতে হবে।
★★★ বর্ষাকাল
বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসের পরে আসে বর্ষাকাল।
বর্ষার শুরু থেকে কার্তিক মাস (June–October) পর্যন্ত প্রায় ৪–৫ মাস সবজির মূল্য বেশি হতে দেখা যায়। এর কারন হলো…
১. বৃষ্টিতে অধিকাংশ ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া।
২. দেশের ১/৩ অংশ জমি পানিতে ডুবে থাকা।
৩. দেশের প্রায় অর্ধেক জমিতে ধান চাষ হওয়া।
এ সময় অত্যাধিক বৃষ্টিতে মাটির জো নষ্ট হয় এবং পরাগায়নে বিঘ্নিত হয়। গাছ মারা গিয়ে বা পচে গিয়েও অনেক ফসল নষ্ট হয়ে যায়। অধিকাংশ কৃষকেরা সবজির জমিতে ধান লাগিয়ে দেয়। এ কারনে প্রায় ৪-৫ মাস ধরে অর্থাৎ বর্ষার শুরু থেকে একেবারে শীতকালীন সবজি বাজারে আসার আগ পর্যন্ত সবজির মূল্য বেশি হয়ে থাকে। তাই সবজি চাষির জন্য এ সময়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
বর্ষার মধ্যে ফলন নেয়ার জন্য এমন সবজি নির্ধারণ করতে হবে যা স্যাঁতসেতে আবহাওয়াতেও মানিয়ে নেয়, গাছ মারা যায় না। ধুন্দল এমন একটি গাছ যা বৃষ্টিতেও সহজে মরে না। লাউ গাছ স্যাঁতসেতে মাটি পছন্দ করে। করলা, ঝিঙ্গা গাছ ও বৃষ্টিতে সহজে মরে না।
তবে বর্ষায় সবজি চাষের জন্য গাছের গোড়া অবশ্যই উচু করে রাখতে হবে অথবা উচু বেড করে গাছ লাগাতে হবে। মালচিং দিয়ে চাষ করলে আরো উত্তম হয়। ধুন্দল ও লাউ গাছ বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে লাগিয়ে দিলে বর্ষায় অল্প কিছু এবং বর্ষার পরেও বেশ কিছু ফলন দিবে। এ দুটি গাছ দির্ঘদিন ফলন দিতে পারে। তবে বর্ষায় গাছ একটু ঘন করে লাগাতে হবে।
অল্প সময় (১-দেড় মাস) ফলন দেয় এমন সবজি বর্ষার আগে না লাগিয়ে বর্ষার শেষ দিকে লাগাতে হবে। করলা, চিচিঙ্গা, শসা, ঝিঙ্গা, মিষ্টিকুমড়াইত্যাদির১৫দিনেরচারাকরেশ্রাবনেরশেষদিকেরোপনকরেদিতেহবে। তাহলে শীতের আগেই ফলন তুলে নেয়া যাবে। এ সময় গ্রীষ্মকালীন জাতের অটোশিম আগাম হিসেবে চাষ করেও ভালো লাভবান হওয়া যায়।
বর্ষার সময় বা পরে বেগুন–মরিচেরও ব্যপক মূল্য লক্ষ করা যায়। তবে এগুলো পানি সহনশীল না হওয়ায় তা করতে হলে উচু জমি বা মালচিং ব্যবহার করে করতে হবে।
★ শীত শুরু হওয়ার পূর্বে (November) আবার আমরা লাউ গাছ সহ অন্যান্য গাছ (গাছের সহনশীলতা বুঝে) লাগিয়ে দিতে পারি। তাহলে শীতকালে সামান্য কিছু ফলন হয়ে শীত শেষে গরম আবহাওয়ায় আবার ফলন এবং মূল্য দোনুটাই বৃদ্ধি পাবে।
শীতকালে সবজি ভালো হয় এবং এ সময় সবজি চাষের ধুম পড়ে যায়। তাই আমরা যদি এ সময়টাতে সবজি করা থেকে একটু পিছিয়ে যায়, তাহলে সাধারণ কৃষকরা কোনরকম মূল্য পেয়ে জীবন যাপন করতে পারবে। আর এই নেক এরাদার কারনে আপনার কিছু পূন্যও হবে।
★ চিত্র:- বছরের কোন সময় সবজির মূল্য উচ্চ হয় আর কোন সময় মূল্য পড়ে যায় তা সহজভাবে দেখানোর জন্য, একটি সম্ভাব্য চিত্র দেয়া হয়েছে।