শিমের সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা হলো ফল ছিদ্রকারী পোকা ও জাব পোকা। শিমের ফলছিদ্রকারী পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য আক্রান্ত ফল তুলে ধ্বংস করতে হবে, শিমগাছের ডগার প্যাঁচ খুলে ছাড়িয়ে দিতে হবে ও এসব করার পর প্রোক্লেম কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম গুলে ক্ষেতে ¯েপ্র করতে হবে। চারা অবস্থায় পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা মহাক্ষতিকর। লাল ক্ষুদ্র মাকড়ও অনেক সময় বেশ ক্ষতি করে থাকে। ফুল ফুটলে থ্রিপস ক্ষতি করতে পারে। ফল পেকে এলে বিন পড বাগ বা শিমের গান্ধি পোকা ক্ষতি করে।
শিমের সবচেয়ে মারাত্মক রোগ দুটি- মোজেইক ও অ্যানথ্রাকনোজ। আইপিএম পদ্ধতি অনুসরণ করে এসব পোকামাকড় ও রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে। মৃত্যুঞ্জয় রায় শিম মানে দেশি শিম। শিম একটি প্রোটিনসমৃদ্ধ সবজি। এর সবুজ বিচিও পুষ্টিকর হিসেবে খাওয়া হয়। এটি জমি ছাড়াও রাস্তার ধারে, আইলে, ঘরের চালে, গাছেও ফলানো যায়। শিম এ দেশে একটি জনপ্রিয় শীতকালের সবজি। এখন আধুনিক জাতের কল্যাণে অসময়েও শিম চাষ করা হচ্ছে। শিম বা ফল সবজি হিসেবে রেঁধে খাওয়া হয়। সবজি হিসেবেই শিম প্রধানত চাষ করা হয়। তবে এর পাতা উত্তম পশুখাদ্য। কেউ কেউ সবুজ সার ফসল ও শোভাবর্ধক ফুলের গাছ হিসেবেও চাষ করেন। ভারতের মহারাষ্ট্রে শ্রাবণ মাসে এক বিশেষ উপবাসে শিম দিয়ে এক মসলা তরকারি রান্না করা হয় যাকে বলে ‘বালা ছে বারডে’। কর্নাটকে সালাদে শিম ব্যবহার করা হয়। তেলেঙ্গানায় পোঙ্গাল উৎসব উপলক্ষে শিমের ফলকে কুচি কুচি করে কেটে এক বিশেষ ধরনের তরকারি রান্না করা হয়। বাজরার রুটি দিয়ে সেই তরকারি খাওয়া হয়। শত বছরের এই ঐতিহ্য সেখানে চলে আসছে। পাকা শিমের বিচি ভেজে বাদামের মতো খাওয়া হয়। শিমের বিচির ডাল একটি উপাদেয় খাবার। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিমের কাঁচা বিচি আলু ও অন্যান্য সবজির সঙ্গে বা শুধু বিচি দিয়ে তরকারি রেঁধে খাওয়া হয়। কেনিয়ায় প্রসূতি মায়ের বুকের দুধ বাড়ানোর জন্য শিম খাওয়ানো হয়। ফল সিদ্ধ করে ভর্তা বানিয়ে খাওয়া হয়। কেনিয়া ও এ দেশে শিমের ভর্তা একটি জনপ্রিয় খাবার। কোনো কোনো দেশে শিমের কচি পাতা পালংশাকের মতো ভেজে খাওয়া হয়।
জলবায়ু ও মাটি ঃ শিম ঠান্ডা ও শুষ্ক জলবায়ুতে ভালো হয়। এটি একটি হ্রস্ব দিবসী উদ্ভিদ। তবে গাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু এবং দীর্ঘ দিবসের দরকার হয়। গাছ যখনই লাগানো হোক না কেন দিনের দৈর্ঘ্য একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে না পৌঁছা পর্যন্ত ফুল ও ফল ধরে না। অতীতে এ দেশে যেসব জাত ছিল সেসব জাতে কোনোভাবেই মধ্য অক্টোবরের আগে ফুল আসত না। এখন গ্রীষ্মকালীন জাত উদ্ভাবিত হওয়ায় গ্রীষ্মকালেও (জুন-জুলাই) ফল ধরছে। এসব জাতের শিমগাছ তাপমাত্রা ও দিবস নিরপেক্ষ হওয়ায় এখন বছরের যে কোনো সময় লাগালে শিম হচ্ছে। দোঁ-আশ ও বেলে দোঁ-আশ মাটিতে শিম ভালো ফলন হয়। নদী তীরের উর্বর পলিমাটিতেও শিম ভালো হয়।
উল্লেখযোগ্য জাত ঃ দেশে ৫০টিরও বেশি স্থানীয় শিমের জাত আছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাইনতারা, হাতিকান, চ্যাপ্টা শিম, ধলা শিম, পুঁটি শিম, ঘৃত কাঞ্চন, সীতাকুন্ডু, নলডক ইত্যাদি। বারি শিম ১, বারিশিম ২, বারি শিম ৫, বারি শিম ৬, বিইউ শিম ৩, ইপসা শিম ১, ইপসা শিম ২, একস্ট্রা আর্লি, আইরেট ইত্যাদি আধুনিক উচ্চফলনশীল জাত। নিচে কয়েকটি আধুনিক জাতের শিমের পরিচয় দেয়া হলো-
বারি শিম-১ মাঝারি আগাম জাত। আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাসে বীজ বপন করতে হয়। প্রতিটি শিমের ওজন ১০-১১ গ্রাম, শিমে ৪-৫ টি বীজ হয়, গাছপ্রতি ৪৫০-৫০০টি শিম ধরে। জীবনকাল ২০০-২২০ দিন। হেক্টর প্রতি ফলন ২০-২২ টন।
বারি শিম-২ আগাম জাত। আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাসে বীজ বপন করতে হয়। প্রতিটি শিমের ওজন ১০-১৩ গ্রাম, শিমে ৪-৫টি বীজ হয়, গাছপ্রতি ৩৮০-৪০০টি শিম ধরে। জীবনকাল ১৯০-২১০ দিন। হেক্টরপ্রতি ফলন ১০-১২ টন।
বারি শিম-৫ শীতকালে হয়। গাছ খাটো, লতায় না বলে এ গাছে মাচার দরকার হয় না। বীজ বোনার ৩৫ থেকে ৪৫ দিন পর থেকেই শিম তোলা শুরু করা যায়। প্রতি গাছে ৫০ থেকে ৭০টি ফল ধরে। এ জাতের জীবনকাল ৭৫ থেকে ৮০ দিন, হেক্টরপ্রতি ফলন ১২.১৩ টন।
বারি শিম-৬ ফল কম আঁশযুক্ত, লম্বাটে, দেখতে অনেকটা নলডক শিমের মতো। গাছপ্রতি ৩০০ থেকে ৩৫০টি শিম ধরে। রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়। ফলন হেক্টরপ্রতি ১৭ থেকে ২০ টন। জীবনকাল ২২০ থেকে ২২৫ দিন। বিইউ শিম-৩ সারা বছর চাষ করা যায়। গ্রীষ্ম মৌসুমেও চাষের উপযোগী। শিমের রঙ বেগুনি। প্রতিটি শিমে গড়ে ৫টি বীজ হয়। হেক্টরপ্রতি ফলন ৭-৮ টন। ইপসা শিম-১ সারা বছর চাষ করা যায়। গ্রীষ্ম মৌসুমেও চাষের উপযোগী। শিমের রঙ বেগুনি। প্রতিটি শিমে গড়ে ৫টি বীজ হয়। হেক্টরপ্রতি ফলন ৫-১০ টন। ইপসা শিম-২ সারা বছর চাষ করা যায়। গ্রীষ্ম মৌসুমেও চাষের উপযোগী। শিমের রঙ সাদাটে সবুজ। প্রতিটি শিমে গড়ে ৪টি বীজ হয়। হেক্টর প্রতি ফলন ৭-৮ টন।
চারা তৈরি ঃ বর্ষাকালে যদি প্রচুর বৃষ্টি হয় তাহলে মাদায় বোনা বীজ পচে যেতে পারে বা মাদার মাটি ধুয়ে বীজ সরে যেতে পারে। এ জন্য ঝুঁকি না নিয়ে এ সময় অনেকে বাড়িতে নিরাপদ স্থানে পলিব্যাগে চারা তৈরি করে নিতে হবে। শ্রাবণের শেষের দিকে বা ভাদ্র মাসে ১০ থেকে ১৫ দিন বয়সী সেসব চারা মাদায় রোপণ করতে হবে।
জমি তৈরি, বীজ বপন ও চারা রোপণ ঃ বেশি জমিতে আবাদ করা হলে সে জমিতে কয়েকটি চাষ ও মই দেয়া ভালো। চাষের পর ২.৫ মিটার চওড়া করে বেড তৈরি করতে হবে। প্রতি বেডের মধ্যে ৫০ সেন্টিমিটার চওড়া ও ১৫ সেন্টিমিটার গভীর নালা রাখতে হবে। প্রতি বেডের কিনার থেকে ৫০ সেন্টিমিটার বাদ দিয়ে সারি করে মাদার জায়গা ঠিক করতে হবে। একটি বেডের উভয় পাশ থেকে এভাবে ৫০ সেন্টিমিটার বাদ দিলে একটি বেডে দুটি সারির মধ্যে দূরত্ব থাকবে ১.৫ মিটার। জোড়া সারি পদ্ধতিতে প্রতি সারিতে ১.৫ মিটার পর পর মাদা তৈরি করতে হবে। মাদার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতার আকার ৪০ সেন্টিমিটার রাখতে হবে। এখন অনেকে বেড ২.৫ মিটার চওড়া না করে ১ মিটার চওড়া করে বেড তৈরি করছেন ও সে বেডের মাঝখানে একটি সারিতে ১ থেকে ১.৫ মিটার পর পর মাদা তৈরি করে বীজ বুনছেন। এতে পরিচর্যা ও ফল তুলতে সুবিধে হয়। ঈশ্বরদী বা পাবনা ও যশোরে অনেকে মাঝারি নিচু জমিতেও শিম চাষ করছেন। সে ক্ষেত্রে মাদা তৈরির আগে মাদার চিহ্নিত স্থানে মাটি তুলে ঢিবির মতো উঁচু করে কয়েকদিন রেখে দিয়ে তারপর সেই ঢিবিতে মাদা তৈরি করে বীজ বুনছেন। খুলনা ও যশোরের কোনো কোনো এলাকায় নিচু জমিতেও শিম চাষ করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সরজান বা কান্দিবেড় পদ্ধতিতে ০.৫ থেকে ১ মিটার গভীর ও ১ মিটার চওড়া করে নালা বা পরিখা খুঁড়ে সেই মাটি দুপাশে উঁচু বেডের মতো তুলে দেয়া হচ্ছে। এসব বেডে শিমের মাদা করে শিম চাষ করা হচ্ছে। নালার ওপরে থাকছে মাচা ও নিচে পানিতে দ্রুত বর্ধনশীল মাছের চাষ করা হচ্ছে।
আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। প্রতি মাদায় ৩ থেকে ৪টি বীজ বুনতে হবে। মাদায় সার মেশানোর ৪ থেকে ৫ দিন পর বীজ বুনতে হবে। বীজ বপনের আগে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা বীজ ভিজিয়ে নিতে হবে। বীজ গজানোর পর ৮ থেকে ১০ দিনের মধ্যে প্রতিটি মাদায় ১টি করে সুস্থ চারা রেখে বাকি চারা তুলে ফেলতে হবে। সাধারণত হেক্টরে ৭.৫ কেজি বীজ লাগে (শতকে ৩০ গ্রাম)। জুন মাসে বা আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বীজ বপন করা যেতে পারে। আগাম শিমের জন্য এ সময়টা উত্তম। গ্রীষ্মকালীন জাতের জন্য বছরের যে কোনো সময় বীজ বোনা যায়।
রোপণ দূরত্ব ঃ একটি মাদা থেকে অন্য মাদার দূরত্ব ১ থেকে ১.৫ মিটার দিলে ভালো হয়। সেচ ও পানি নিকাশ ঃ কোন অবস্থাতেই গাছের গোড়ায় পানি যাতে না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে জমিতে প্রয়োজন মতো সেচ দিতে হবে। আগাছা পরিষ্কার ঃ মাঝেমধ্যে মাটি নিড়ানি দিয়ে মাদার মাটি আলগা করে দিতে হবে। মাচা বা বাউনি দেয়া ঃ শিম গাছ যখন ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা হবে তখন মাদার গাছের গোড়ার পাশে বাঁশের ডগা মাটিতে পুঁতে বাউনির ব্যবস্থা করতে হবে।
শাখা ছাঁটাই ঃ পুরনো ও মরা শাখা, ডগা ছাঁটাই করে পরিষ্কার করে দিতে হবে। যেসব ডগায় ফুল ফোটে না সেসব ডগা ছেঁটে পরিষ্কার করে দিলে গাছে বেশি ফুল আসে। ডগার প্যাঁচ খোলা ঃ শিমের ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ কমাতে ও বেশি ফুল ধরাতে জড়াজড়ি করে থাকা ডগাগুলোর প্যাঁচ খুলে দিতে হবে। ফসল তোলা ও ফলন ঃ জাতভেদে বীজ বোনার ৯৫ থেকে ১৪৫ দিন পর শিম তোলা যায়। সাধারণত আশ্বিন-কার্তিক মাসে ফুল ধরে। ফুল ফোটার ২০ থেকে ২৫ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়। শিমগাছ ৪ মাসেরও বেশি সময় ধরে ফল দেয়। ফলনপ্রতি শতকে ৬০ থেকে ৮০ কেজি, হেক্টরপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টন।
User Reviews
Be the first to review “নলডোগ শিম বীজ (১ গ্রাম)”
General Inquiries
There are no inquiries yet.
There are no reviews yet.